একটি সমাজকে এগিয়ে নিতে, একটি জাতিকে সমৃদ্ধ করতে, একটি রাষ্ট্রকে উন্নত ও আধুনিক রাষ্ট্রে পরিণত করার জন্য সমাজের যে শ্রেণী পেশার মানুষের ভূমিকা সর্বাগ্রে, তারা হচ্ছেন শিক্ষক শ্রেণি। তারাই পারেন তাদের পেশার সর্বোত্তম ব্যবহারের মাধ্যমে সমাজকে আলোকিত করতে। বস্তুত সমাজকে এগিয়ে নিতে অন্যান্য শ্রেণি-পেশার মানুষও গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন কিন্তু একজন শিক্ষক সমাজকে যতটা দিতে পারেন তা নিঃসন্দেহে অনন্য।
এজন্যই সবাই এই পেশাকে মহান পেশা হিসেবে মূল্যায়ন করেন, এজন্যই শিক্ষকদের সম্মান ও শ্রদ্ধার চোখে দেখা হয়। এটা শুধুমাত্র আমাদের দেশেই নয় বরং পৃথিবীর সমস্ত দেশে, সমস্ত কালে এমনটাই হয়ে আসছে। একজন শিশুর শ্রেণিকক্ষের পাঠের বাইরে তার নান্দনিক উপলব্ধি, সৃজনশীল ভাবনা, দেশপ্রেমে উদ্বুদ্ধকরন ও তার জ্ঞান ভান্ডারকে সমৃদ্ধকরণে একজন শিক্ষকের ভূমিকা অনস্বীকার্য। একজন শিক্ষক একটি ছাত্রকে স্বপ্ন দেখায় ভালো কিছু করতে। শিক্ষকই শিক্ষার্থীকে স্বপ্ন দেখান তার দেশের জন্য কিছু করতে, উদ্বুদ্ধ করেন তার রাষ্ট্রের জন্য কিছু করতে। শিক্ষার্থীকে সামাজিকীকরণে ও তার ব্যক্তিসত্তার সর্বাঙ্গীণ বিকাশে প্রধান ভূমিকা রাখেন শিক্ষক। যদিও এক্ষেত্রে শিক্ষার্থীর পরিবারের ভূমিকাও মুখ্য কিন্তু শিক্ষার্থীদের পাঠদানের পাশাপাশি অভিভাবকদের সঙ্গে সুসম্পর্ক স্থাপনের মধ্য দিয়ে শিক্ষার্থীর শিক্ষা ব্যবস্থার সুবিধা অসুবিধা দূর করেন শিক্ষকই। একজন শিক্ষার্থী তার শিক্ষকের দ্বারা প্রচন্ডভাবে প্রভাবিত হয়।
শিক্ষকের মানসিকতা, আচরণ ও দৃষ্টিভঙ্গি শিক্ষার্থীর মনে সুদূরপ্রসারী প্রভাব ফেলে। এখন শিক্ষকের মানসিকতা, আচার-আচরণ যদি ইতিবাচক হয় তাহলে শিক্ষার্থীও ইতিবাচক দৃষ্টিভঙ্গি নিয়ে বেড়ে উঠবে; একসময় সেও তার আহরিত ইতিবাচক জ্ঞান ও অর্জিত শিক্ষার প্রয়োগের মাধ্যমে দেশ ও রাষ্ট্রের জন্য কল্যাণ বয়ে নিয়ে আসবে। এভাবেই একজন শিক্ষক দেশের কল্যাণে ও রাষ্ট্রের কল্যাণে পরোক্ষভাবে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন।
এক্ষেত্রে উইলিয়াম আর্থার ওয়ার্ডের উক্তিটি এখানে প্রণিধানযোগ্য, তার মতে, "মাঝারি মানের শিক্ষক বলেন, ভালো শিক্ষক বুঝিয়ে দেন, শ্রেষ্ঠ শিক্ষক করে দেখান, মহান শিক্ষক অনুপ্রাণিত করেন।" অর্থাৎ শিক্ষক মূলত পরশপাথর হিসেবে ভূমিকা পালন করেন। তার সংস্পর্শে ও তার সাহচর্যে সাধারণ হয় অসাধারণ, জনগণ পরিণত হয় জনসম্পদে। যার বহিঃপ্রকাশ আমরা সাম্প্রতিক সময়ে ঘটে যাওয়া কোটা সংস্কার আন্দোলন থেকে বৈষম্য বিরোধী অধিকার আন্দোলন ও পরবর্তীতে দেশের সরকার পরিবর্তনের মধ্যে দেখেছি। যেখানে নেপথ্যে থেকে বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের শিক্ষকসম্প্রদায় দেশের সংকটে শিক্ষার্থী ও নাগরিকের চেতনাকে জাগ্রত করতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছেন।
মনে রাখতে হবে শিক্ষকই সমাজের অভিভাবক, সভ্যতার অভিভাবক। যখনই সমাজে সংকট তৈরি হয়, তখনই সেই সংকট ও বৈষম্যের প্রতিবাদের নেতৃত্বের প্রথমসারিতেই থাকেন শিক্ষকসমাজ। পালন করেন গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা, যার মাধ্যমে তার শিষ্য বা অনুসারিরা প্রভাবিত হন এবং দেশ ও দশের ভালোর জন্য অবদান রাখেন। এজন্যই চীনের প্রাচীন দার্শনিক কনফুসিয়াস বলেছেন, "শিক্ষক হবেন জ্ঞান ও প্রজ্ঞার উৎস। তিনি হবেন একজন আদর্শ শাসক।"
শিক্ষা জাতির মেরুদণ্ড, শিক্ষা ছাড়া কোন জাতি উন্নতি করতে পারে না। আর এ মেরুদন্ড যে কারখানায় তৈরি হয় তার নাম প্রাথমিক বিদ্যালয়। একটি শিশু ভবিষ্যতে কতটুকু ন্যায়-নীতিবান, আদর্শবান, চরিত্রবান হবে এটি অনেকাংশে নির্ভর করে তার প্রাথমিক শিক্ষার উপর। প্রখ্যাত লেখক জন মিল্টনের মতে, "The childhood shows the man, as morning shows the day." যার অর্থ উঠন্তি মূলো পত্তনেই চেনা যায় বা সকালেই দিন বোঝা যায়। অর্থাৎ শিশুকাল থেকেই যদি সঠিক শিক্ষা দেওয়া যায় তাহলে মানুষ হিসেবে আদর্শবান মানুষ গড়া সম্ভব। কারন শিক্ষার মূল ভিত্তি হচ্ছে প্রাথমিক শিক্ষা আর এর কারিগর হচ্ছেন প্রাথমিক শিক্ষক। তারাই একটি শিশুর মনে প্রথম বীজ রোপন করেন সততার, কর্তব্যপরায়ণতার, কাজের প্রতি আন্তরিকতার, পরোপকারিতার, মানবসেবার ও দেশপ্রেমের।
এই প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষকরা বাবা মায়ের স্নেহ-মমতা দিয়ে শেখান কিভাবে অপরের সাথে সুন্দর আচরণ করতে হয়, কিভাবে সুন্দরভাবে কথা বলতে হয়, কিভাবে নিয়ম মেনে রাস্তায় চলাচল করতে হয়, কিভাবে অন্যের বিপদে এগিয়ে আসতে হয়, কিভাবে দলগতভাবে সমস্যার সমাধান করতে হয়, কিভাবে নিজের আনন্দ ভাগ করে নিতে হয়, আবার অন্যের দুঃখে সমবেদনা জানাতে হয়। তাই শিক্ষার পাশাপাশি শিক্ষকদের গুরুত্ব অনস্বীকার্য। এজন্য শিক্ষকদের যথাযথ মর্যাদা দেয়া প্রয়োজন। শিক্ষকরা যেন ভাল থাকেন, সুস্থ থাকেন, তাদের সুযোগ-সুবিধা পর্যালোচনা করা একটি দেশের দায়িত্ব ও কর্তব্যের মধ্যে পড়ে।
বর্তমানে আমাদের দেশে খুবই অসহায় ও বিধ্বস্ত অবস্থায় আছেন শিক্ষকশ্রেণীর সর্বপ্রথম স্তরের শিক্ষক প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষকবৃন্দ। একথা বলা যেমন কষ্টের, তেমনি কিছুটা ক্ষোভেরও। একজন অনার্স মাস্টার্স সম্পন্ন শিক্ষক যখন প্রাইমারি স্কুলে যোগদান করবেন তখন তিনি বাংলাদেশের বেতন কাঠামোর যে চারটি ধাপ আছে সেখানকার তৃতীয় ধাপে বা ১৩ তম গ্রেডে চাকরি শুরু করবেন। কিন্তু এটা কখনও ভাবা যায় কিংবা মেনে নেওয়া যায়? একজন অনার্স মাস্টার্স সম্পন্ন শিক্ষক তিনি হবেন তৃতীয় শ্রেণীর কর্মচারী! একথা আমাদের মনে রাখা প্রয়োজন উন্নত জীবন যাপন কিন্তু উন্নত চিন্তা ভাবনা করতে শেখায়। যদি শিক্ষক শ্রেণী উন্নত জীবন যাপন না করেন, তাকে যদি শ্রেণীকক্ষের বাইরে তার পরিবারকে নিয়ে ভাবতে হয়, তার আর্থিক সমস্যা নিয়ে ভাবতে হয়, তাহলে তাকে তার ছাত্র-ছাত্রীদের নিয়ে ভাবা বা গবেষণা করা বা উন্নত শিক্ষাদান করা কষ্টের কিংবা অসম্ভব হয়ে দাঁড়ায়। কিংবা পাঠদানের বাইরে তার সময়ইবা কই ছাত্রছাত্রীদের নিয়ে গবেষণা করার? যদিও এখানে তার পেশাদারি মনোভাব ও মহত্বের প্রশ্ন চলে আসে, তবুও আমাদের ভাবতে হবে বর্তমান পুঁজিবাদী সমাজ ব্যাবস্থায় অর্থ দিয়েই সকলকে মাপা হয়।
আর এই বাটখারায় বর্তমানে শিক্ষক সমাজের দীনতাই প্রকাশ পায়। এজন্য মনে করি সরকারের উচিত হবে শিক্ষকদের চলমান সমস্যা দূর করে তাদের জন্য আলাদা বেতন কাঠামো তৈরি করা, যাতে করে তাদের সামাজিক স্বীকৃতির পাশাপাশি আর্থিকভাবেও যেন প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষকসমাজ স্বচ্ছলতার সাথে জীবন যাপন করতে পারেন। এ ব্যাপারে মাসলো'র চাহিদার সোপান তত্ত্বের মাধ্যমে বিষয়টি ব্যাখা করা যেতে পারে। তার মতে মানুষের পাঁচটি চাহিদাক্রম -১. শারীরিক বা দৈহিক প্রয়োজন (Physiological Needs), ২. নিরাপত্তার প্রয়োজন (Security Needs), ৩. সামাজিক প্রয়োজন (Social Needs), ৪. আত্মতৃপ্তির প্রয়োজন (Ego Needs), ৫. সৃজনশীলতা ও বিশেষ অবদানের প্রয়োজন (Self Actualisation Needs) অর্থাৎ মানুষের একটি চাহিদা পূরণের পরেই অন্যটির অভাব অনুভব হয়। এক্ষেত্রে দেশের ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের পক্ষে আর্থিক ও অন্যান্য সুযোগ সুবিধা প্রাপ্তির জন্য উল্লিখিত ধাপের অধিকাংশ প্রয়োজনগুলো মেটানো সম্ভব হলেও প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষকদের আর্থিক ও গ্রেড বৈষম্যের জন্য মাসলোর তত্ত্বের নিচের চাহিদাগুলোই পূরণ করা সম্ভব হয় না।
এছাড়া এই ব্যাপারে বৈষম্য এমন পর্যায়ে পৌছিয়েছে যে তা শিক্ষকদের জন্য সামাজিকভাবে ও আর্থিকভাবে সত্যিই দৃষ্টিকটু ও মর্যাদাহানিকর। তাছাড়া কেনইবা একই যোগ্যতা ও একই কারিকুলাম থাকা সত্ত্বেও পিটিআই সংশ্লিষ্ট পরীক্ষণ বিদ্যালয়ের সহকারী শিক্ষকদের বেতনগ্রেড ১০ম আর সারাদেশের ৬৫৫৬৭টি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের সহকারী শিক্ষকদের বেতনগ্রেড ১৩তম বা তিনি হচ্ছেন তৃতীয় শ্রেণির একজন কর্মচারী! এছাড়াও অন্যান্য বিভাগের চাকরির সাথে তুলনা করলেও এখানে স্পষ্ট বৈষম্য প্রকাশ পায়। প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষকের নিয়োগ যোগ্যতা স্নাতক সমমান (২য় শ্রেণি) কিন্তু তাদের বেতনগ্রেড ১৩তম অথচ একই যোগ্যতায় সরকারি মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষকের বেতনগ্রেড ১০ম, পুলিশের সাব-ইন্সপেক্টর ১০ম গ্রেড, বিভিন্ন মন্ত্রণালয়ের প্রশাসনিক কর্মকর্তার বেতনগ্রেড ১০ম ও ৯ম। এছাড়াও নার্সদের নিয়োগ যোগ্যতা এইচএসসি ও ডিপ্লোমা ইন নার্সিং, তাদের বেতনগ্রেড ১০ম।
আবার উপ-সহকারী কৃষি কর্মকর্তার নিয়োগ যোগ্যতা এইচএসসি ও ৪ বছরের কৃষি ডিপ্লোমা এবং তাদেরও বেতনগ্রেড ১০ম। অথচ পড়াশোনা শেষ করে এই মহৎ পেশায় নতুন নিয়োগ পাওয়া একজন শিক্ষক ১৩ তম গ্রেডে ১১,০০০/ টাকা বেতন স্কেলে সকল ভাতা মিলিয়ে সাকুল্যে (উপজেলাভিত্তিক) ১৭,৬৫০/- টাকা পায়। যা দিয়ে আজকের এই উর্ধ্বমুখী দ্রব্যমূল্যের বাজারে মাসিক এ বেতনে সংকুলান না হয়ে অনেক ক্ষেত্রে প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষকদের ঋণের বোঝা মাথায় নিয়ে হতাশা ও মনোকষ্ট নিয়ে যাপিত জীবন অতিবাহিত করতে হচ্ছে, যা খুবই দুঃখজনক। এর বাইরেও প্রাথমিক বিদ্যালয় ও প্রাথমিক শিক্ষকদের চাকুরী সংক্রান্ত আরো কিছু সমস্যা রয়েছে যার সংস্কার খুবই জরুরী।
প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষকদের বর্তমানে যে সমস্যাগুলো সমাধান করা অত্যাবশ্যক বলে প্রতীয়মান হচ্ছে সেসব পর্যালোচনা
নিম্নে তুলে ধরছি :
১. প্রাথমিক বিদ্যালয়ের সহকারি শিক্ষকদের ১০ম গ্রেড প্রদান করা।
২. প্রধান শিক্ষকদের ৯ম গ্রেড প্রদান করা।
৩. যথাসময়ে এবং প্রযুক্তিগত সহায়তার মাধ্যমে স্বয়ংক্রিয়ভাবে উচ্চতর গ্রেড, টাইমস্কেল ও শ্রান্তি বিনোদন ভাতা প্রদান করা।
৪. ডিপিএড সার্টিফিকেটকে বিএড সমমানের মর্যাদা দেওয়া এবং বর্তমানের বিটিপিটি ট্রেনিং করার পর অর্জিত সার্টিফিকেট সার্ভিসবুকে সংযুক্ত করার সাথে উচ্চতর স্কেল প্রদান করা এবং এই সার্টিফিকেট অর্জনকারীদেরকে প্রাথমিক শিক্ষা অধিদপ্তরাধীন বিভিন্ন চাকুরী পরীক্ষায় বিভাগীয় প্রার্থীতা প্রদান করা।
৫ প্রতিটা স্কুলে কম্পিউটার অপারেটর ও দপ্তরী নিয়োগ করা এবং বর্তমানে নিয়োজিত মাস্টাররোলে অন্তর্ভুক্ত সকলকে রাজস্বতে অন্তর্ভুক্ত করা।
৬. প্রতিটি বিদ্যালয়কে এক শিফটে রূপান্তরিত করা এবং ক্লাশে শিক্ষক ও ছাত্রছাত্রীদের সংখ্যার অনুপাত সর্বোচ্চ ১:৪০/৪৫ এর মধ্যেই সীমিত রাখা। অতিরিক্ত ছাত্রছাত্রীদের জন্য সরকারকে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নিতে হবে। মনে রাখতে হবে একটি ক্লাশে একজন শিক্ষকের জন্য ৪০/৪৫ এর বেশি ছাত্রছাত্রী হ্যান্ডেল করা কষ্টকর। এমন হলে ওই শিক্ষকের দ্বারা ভালো মানের শিক্ষাদান করা সম্ভব নয়।
৭. প্রতিটা বিদ্যালয়ের আধুনিক ওয়াশব্লক বা পয়ঃনিষ্কাশন ব্যবস্থা, বিশুদ্ধ পানির ব্যবস্থা, বিদ্যুৎ সংযোগ, ইন্টারনেট সংযোগ, সীমানা প্রাচীর তৈরী, ছাত্র-ছাত্রীদের সংখ্যানুযায়ী কক্ষ/বিল্ডিং তৈরি/মেরামত, বিদ্যালয়ের সাথে সংযুক্ত করে রাস্তা নির্মাণ/মেরামত করা।
৮. এক স্কুলে/উপজেলায়/জেলায় একজন শিক্ষক/এইউইও/ইউইও/এডিপিইও/ডিপিইও/ইউআরসি ইন্সট্রাক্টর/অফিস সহকারীর চাকুরীকাল ৩/৫ বছরের বেশি হলেই বদলি হতে হবে এবং বদলির কার্যক্রম হবে স্বয়ংক্রিয়ভাবেই। শিক্ষকদের মধ্যে পারস্পরিক বদলী চালু করতে হবে।
৯. পেনশনের সকল কার্যক্রম এক মাসের মধ্যেই শেষ করতে হবে এবং এটা হবে স্বয়ংক্রিয়ভাবেই, এ ব্যাপারে কোনভাবেই কোন শিক্ষককে হয়রানি করা যাবে না। একইসাথে কল্যাণ ফান্ডের টাকা উত্তোলনে হয়রানি বন্ধ ও এর প্রক্রিয়া সহজতর করা।
১০. একই নিয়োগবিধি হবে শিক্ষক ও কর্মকর্তাদের জন্য, আলাদা কোনো নিয়োগবিধি থাকবে না। প্রাথমিক শিক্ষা ক্যাডার সৃষ্টি, সহকারী শিক্ষক পদকে এন্ট্রি পদ ধরে মহাপরিচালক পর্যন্ত শতভাগ পদোন্নতির মাধ্যমে নিয়োগ প্রদান করা। সরাসরি প্রধান শিক্ষক, সহকারী উপজেলা প্রাথমিক শিক্ষা অফিসার, উপজেলা প্রাথমিক শিক্ষা অফিসার ও সহকারী জেলা প্রাথমিক শিক্ষা অফিসার নিয়োগ বন্ধ করা।
১১. পদোন্নতির ক্ষেত্রে ঊর্ধ্বতন পোস্টগুলোতে ১০০% শিক্ষকদের থেকে নিতে হবে। অর্থাৎ মন্ত্রণালয়, অধিদপ্তর ও নেপের প্রশাসনিক ও প্রশিক্ষণের পোস্টগুলোতে যারাই পদোন্নতি পাবেন তারা চাকুরী জীবনের প্রথমকালে সহকারী শিক্ষক হিসেবে দায়িত্ব পালন করবেন। আর এই পদোন্নতি হবে ৫০% জ্যেষ্ঠতার ভিত্তিতে এবং ৫০% বিভাগীয় পরীক্ষার মাধ্যমে। বিভাগীয় পরীক্ষায় সকল শিক্ষক অংশগ্রহণ করতে পারবেন। এতে করে শিক্ষকরা সবসময়ের জন্য আপডেট থাকবেন।
১২. প্রাথমিক শিক্ষা অধিদপ্তরের একটি হট লাইন চালু করতে হবে, যার মাধ্যমে শিক্ষক ও ছাত্রছাত্রীদের বিভিন্ন অসুবিধার কথা মাঠপর্যায় থেকে সরাসরি অধিদপ্তর যেন শুনতে পারেন ও তার দ্রুত তদন্তের মাধ্যমে যথাযথ ব্যবস্থা নিতে পারেন। এর মাধ্যমে ঘুষ বানিজ্য ও দুর্নীতির সাথে সংশ্লিষ্ট অপরাধীরা ভয় পাবে এবং এই ধরণের অপসংস্কৃতি চর্চা রোধ করা সম্ভব হবে বলে মনে করছি।
১৩. শিক্ষকদের আধুনিক শিক্ষাদানের জন্য প্রতিনিয়ত ট্রেনিংয়ের ব্যবস্থা করা এবং ট্রেনিং শেষে অর্জিত জ্ঞান বিদ্যালয়ে বাস্তবায়ন হচ্ছে কি না তার তদারকি করা। একইসাথে শিক্ষকদের পাঠদান ব্যতীত অন্যকাজে ব্যস্ত না রাখা।
১৪. শিক্ষকদের জন্য আলাদা ব্যাংক ও হাসপাতাল নির্মাণ করার উদ্যোগ গ্রহণ করা।
১৫. প্রাথমিক শিক্ষা অধিদপ্তরের বর্তমানের চলতি দায়িত্বপ্রাপ্তদের দ্রুত পদোন্নতি দেওয়া এবং ভবিষ্যতে চলতি দায়িত্ব দেওয়া বন্ধ করে বরং পদোন্নতিকে নিয়মিতকরণ করা।
১৬. শিক্ষকদের ও শিক্ষার্থীদের আইডি কার্ড প্রদান এবং তা ব্যবহার বাধ্যতামূলক করা।
১৭. প্রাথমিক শিক্ষা অধিদপ্তরের সমস্ত মামলার দ্রুত নিষ্পত্তি করা।
১৮. শিক্ষকদের টিফিন ভাতা, চিকিৎসা ভাতা বাজার দর অনুযায়ী বৃদ্ধি এবং এর পাশাপাশি চরাঞ্চলের শিক্ষকদের জন্য হাওর অঞ্চলের শিক্ষকদের মত যাতায়াত ভাতা প্রদান করা। এছাড়াও কর্মস্থল বাসা থেকে ১৫ কি.মি-এর বেশি হলে যাতায়াত ভাতা প্রদান করা।
১৯. প্রাথমিক শিক্ষকদের স্বল্পসুদে হোম লোন প্রদান করা।
২০. শিশুরা মূলত আনন্দের মধ্যেই শিখে। তাদের শারিরিক ও দৈহিক বিকাশে গতানুগতিক পড়াশোনার পাশাপাশি তাই খেলাধুলাও গুরুত্বপূর্ণ। এজন্য শিক্ষার্থীদের পর্যাপ্ত খেলাধুলার সময় রাখার জন্য বিদ্যালয়ের সময়সূচি ৯টা/১০টা থেকে ৩টা পর্যন্ত করা।
২১. পেশায় পদোন্নতি হবে নিয়মিত তবে সকলকে পদন্নোতি না দিতে পারলে উচ্চতর গ্রেড দিয়ে শিক্ষককে সন্তুষ্ট রাখতে হবে যাতে করে শিক্ষকের মনোযোগ সবসময়ই ছাত্রছাত্রীদের প্রতিই থাকে, সে যেন কখনো তার পেশার প্রতি অসন্তোষ প্রকাশ না করে তার দিকে লক্ষ্য রাখা।
২২. বিদ্যালয়ের ব্যবস্থাপনা কমিটির সংস্কার করা। দেখা যায় অধিকাংশ বিদ্যালয়েই এই কমিটির মাধ্যমে বিদ্যালয়ের জন্য বরাদ্দকৃত অর্থ কমিটির প্রধান সদস্যদের প্রয়োজনেই বেশি ব্যয় করা হয়। অনেক সময় স্থানীয় প্রভাব বা প্রশাসনিক অনৈতিক প্রভাবের জন্য ইচ্ছা থাকা সত্ত্বেও দায়িত্বপ্রাপ্ত শিক্ষক সম্পূর্ণ অর্থের সুষ্ঠু ব্যবহার করতে পারেন না। এ ব্যাপারে বিদ্যালয়ের কমিটিতে সকল শিক্ষকের অংশগ্রহণ রাখতে হবে এবং তাদের মতামতের প্রাধান্য দিতে হবে। বিদ্যালয়ের বিভিন্ন ধরনের খাতে বরাদ্দকৃত অর্থের সুষ্ঠু তদন্ত করা উচিত। মনে রাখতে হবে শিক্ষক যদি কোনভাবে কোন অনৈতিক কার্যকলাপে জড়িয়ে যায় তাহলে তার থেকে নৈতিক শিক্ষা আশা করা দুরূহ। এর পাশাপাশি এটিইও এবং টিইওদেরকেও স্বচ্ছতার পরিচয় দিতে হবে।
২৩. শিক্ষকদের শিক্ষা দেওয়ার মানের উপর ছাত্রছাত্রীদের রিভিউ নেওয়া, এতে করে শিক্ষকরা তাদের শিক্ষাদানের ব্যাপারে আরো যত্নশীল হবে এবং আপডেট থাকবেন নিয়মিত। এ ব্যাপারে শিক্ষকদের রেটিং সিস্টেম চালু করা যেতে পারে।
২৪. প্রতিটি বিদ্যালয়ে ছাত্রছাত্রীদের অনুপাতে শিক্ষকদের নিয়োগ দিতে হবে। বিদ্যালয়ে শারিরিক শিক্ষা, আর্ট, আইসিটি, ধর্ম ও নৈতিকতার জন্য আলাদা শিক্ষক নিয়োগ দিতে হবে। প্রতি বিদ্যালয়ে না হলেও ক্লাস্টার অনুযায়ী এই শিক্ষকবৃন্দ রুটিন করে বিভিন্ন স্কুলে শিক্ষাদান করবেন।
২৫. শিক্ষার্থীদের স্বাস্থ্য ঠিক রাখার জন্য মেডিকেলের ইন্টার্নির ছাত্রছাত্রীদের/নার্সদের ত্রৈমাসিক ভিত্তিতে (তাদের অ্যাসাইনমেন্ট হিসেবে) একটি ক্লাশ নেওয়ার ব্যবস্থা করা যেতে পারে। এর মাধ্যমে ছাত্রছাত্রীরা তাদের স্বাস্থ্য সম্পর্কে ছোট থেকেই সচেতন থাকবে ও অভিভাবকেরাও সন্তানদের প্রতি যত্নশীল হবেন।
২৬. বিদ্যালয়ে বিভিন্ন দিবসকে কেন্দ্র করে বিশেষ ক্লাশ নেওয়া/দিবসভিত্তিক অনুষ্ঠানের আয়োজন করা এবং সেখানে ছাত্রছাত্রীদের স্বতঃস্ফূর্ত অংশগ্রহণে উদ্বুদ্ধ করা, একইসাথে দিবসে যেহেতু বিদ্যালয়ে শিক্ষকদের যেতে হয় সেহেতু সেইদিনগুলোকে কর্মদিবস হিসেবে গণ্য করা।
২৭. প্রতিটি বিদ্যালয়ে আইসিটি ও মাল্টিমিডিয়ার মাধ্যমে শ্রেণি কার্যক্রম বাধ্যতামূলক করা ও তার জন্য প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহন করা৷ এ ব্যাপারে একজন আইটি এক্সপার্ট শিক্ষক প্রতি বিদ্যালয়েই নিয়োগ দেওয়া অথবা আইটি ট্রেনিং-এর যথাযথ ব্যবস্থা করে শিক্ষককে এ বিষয়ে দক্ষ করে গড়ে তুলতে সহযোগিতা করা।
২৮. কোন শিক্ষক/কর্মকর্তা যদি কোন গবেষণা কিংবা শিক্ষা ব্যবস্থার মানোন্নয়ন বা সমস্যার সমাধানের ব্যাপারে উল্লেখযোগ্য অবদান রাখেন তাহলে তার জন্য পুরষ্কারের ব্যবস্থা করা যা একজন শিক্ষক/কর্মকর্তাকে সবসময়ে ভালো কিছু করতে উৎসাহ দিবে ও অনুপ্রেরণা যোগাবে।
২৯. প্রাথমিক বিদ্যালয়কে ননভ্যাকেশনাল ডিপার্টমেন্ট ঘোষণা করা।
৩০. শিক্ষক ঘাটতি পূরণের লক্ষে প্রয়োজনীয় শিক্ষক নিয়োগ দেওয়া। তবে সংবাদমাধ্যমে ইদানিং লক্ষ্য করা যাচ্ছে, প্রাথমিক শিক্ষক নিয়োগ পরীক্ষায় প্রতিনিয়ত প্রশ্নফাঁসের ঘটনা ঘটছে যা খুবই উদ্বেগজনক। তাই এ ব্যাপারে কঠোর ব্যবস্থা গ্রহণ করা। কারণ অসুদোপায় অবলম্বনের মাধ্যমে কেউ শিক্ষক হলে তার থেকে নৈতিক শিক্ষা আশা করা অসম্ভব। স্বচ্ছতার জন্য শিক্ষক নিয়োগ পরীক্ষা তৃতীয় কোন পক্ষ বা বিপিএসসি'র মাধ্যমে নেওয়ার ব্যবস্থা করা।
৩১. প্রাথমিক শিক্ষায় নীতি-নৈতিকতা, মূল্যবোধ তৈরি, আত্মসংযম, দলীয়ভাবে এগিয়ে যাওয়ার শিক্ষা ও এর গুরুত্ব, দেশপ্রেম জাগ্রতকরণ, বিভিন্ন অন্যায় হতে নিরাপদ থাকা ও তার বিরুদ্ধে প্রতিবাদের শিক্ষা ও চর্চার প্রতি সর্বোচ্চ গুরুত্বারোপ করা। এমনকি এই গুরুত্ব বিষয়ভিত্তিক চর্চার থেকেও বেশি গুরুত্বপূর্ণ। মনে রাখতে হবে প্রাথমিক শিক্ষাই একটি জাতির ভিত্তি। সমাজ থেকে অবক্ষয় দূর করতে হলে প্রাথমিক বিদ্যালয়ের ছাত্র-ছাত্রীদের নীতি-নৈতিকতার চর্চার কোন বিকল্প নেই। জীবনের প্রথম থেকেই যদি ছাত্রছাত্রীরা নীতি-নৈতিকতার চর্চার অভ্যাস গড়ে তা তাদের ভবিষ্যৎ জীবনে প্রভাব ফেলবে। সর্বোপরি দেশে একটি ইতিবাচক প্রজন্ম, সভ্য সমাজ তৈরি হবে।
উপর্যুক্ত অনেক দাবী শুধু সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাদের স্বদিচ্ছার উপরেই নির্ভর করে। যথাযথ কর্তৃপক্ষ যদি ইচ্ছাপোষণ করেন তাহলে অবহেলিত প্রাথমিক শিক্ষক সমাজের অনেক দুঃখ-কষ্ট লাঘব করা সম্ভব। মনে রাখতে হবে, যে দেশে গুণীর কদর নাই, সে দেশে গুণীর জন্ম হয় না। চাপে রেখে দায় সারা যেতে পারে কিন্তু দায়িত্ব না! কর্তৃপক্ষ উপরের অবস্থানে আছেনই তার অধস্তনদের সুবিধা-অসুবিধা দেখভাল করার জন্য। এক্ষেত্রে তাদের অবশ্যই গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করতে হবে। কারন - "With great power comes great responsibility"
একটা কথা খুবই জরুরি বলে প্রতীয়মান হচ্ছে, বর্তমানে যে কোনো যৌক্তিক দাবি যেন আন্দোলন সংগ্রাম করে আদায় করে নেওয়াটা একটা ট্রেডিশনে রূপান্তরিত হচ্ছে। কিন্তু এটা নাগরিক অধিকারের পরিপন্থী বলেই প্রতীয়মান হয়। যেকোন যৌক্তিক দাবি যদি যথাযথ কর্তৃপক্ষের দৃষ্টিগোচর করা হয় তাহলে তার বাস্তবায়ন করা যথাযথ কর্তৃপক্ষের দায়িত্বের মধ্যেই পড়ে। তারাই এর গুরুত্ব উপলব্ধি করে উল্লিখিত দাবীগুলো বাস্তবায়ন করা আবশ্যক। মনে রাখতে হবে শিক্ষাকে যদি একটি বিল্ডিং এর সাথে তুলনা করি, তাহলে তার ভিত্তি হচ্ছে প্রাথমিক শিক্ষা আর প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষক হচ্ছেন এর কারিগর। কোনোভাবেই প্রাথমিক শিক্ষাকে যেমন গুরুত্বহীন মনে করার সুযোগ নেই, তেমনি এর সাথে সংশ্লিষ্ট শিক্ষকগণের সাহায্য ছাড়া শিক্ষার্থীর পক্ষে কোন কিছু শেখা সম্ভব নয়। কারণ শিক্ষককে বাদ দিয়ে কোন শিক্ষা ব্যবস্থা এখনো গড়ে ওঠেনি পৃথিবীতে। শিক্ষক শিক্ষার্থীর জ্ঞান অর্জনের সহায়তাকারীর পাশাপাশি তিনি একাধারে শিক্ষার্থীর সহায়ক বন্ধু, পরামর্শদাতা, অভিভাবক, হিতৈষী ও পথপ্রদর্শক। তাই তাদের সুযোগ-সুবিধা প্রদান এবং তাদের চলমান অসুবিধা বা সমস্যা সমাধান করা সমাজ তথা দেশেরও দায়িত্ব এবং কর্তব্য।
এন ইউ প্রিন্স
সহকারী শিক্ষক
হাওলাদার ডাঙ্গী সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়,
সদরপুর, ফরিদপুর।
মন্তব্য