আত্মহত্যা নয় বরং বেঁচে থাকাই সমাধান 

  • মিজানুর রহমান 
  • বৃহস্পতিবার, ২১ সেপ্টেম্বর ২০২৩ ০১:০৯:০০
  • কপি লিঙ্ক

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের চীনা ভাষা ও সংস্কৃতি বিভাগের একজন শিক্ষার্থী নাম কাজী ফিরোজ মঙ্গলবার রাতে বিজয় একাত্তর হলের ভবন ‘যমুনা’ থেকে পড়ে মারা গেছেন। তার এই মৃত্যু দুর্ঘটনা নাকি আত্মহত্যা সেটা তদন্তের বিষয়। তবে তার লিখে রেখে যাওয়া নোট ও সহপাঠীদের ভাষ্যমতে- এটা ‘আত্মহত্যা’ বলে মনে করছেন তার সম্পর্কে জ্ঞাত সংশ্লিষ্টরা। তার রেখে যাওয়া নোটে লেখা, ‘আমার ওয়ালেটের কার্ডে কিছু টাকা আছে। বন্ধুদের কাছে অনুরোধ রইল মায়ের হাতে দিতে। কার্ডের পাসওয়ার্ড ৮০৭৪। আর ফোনের লক খুলে দিয়ে গেলাম। আমার লাশের পোস্টমর্টাম না করে যেন বাড়িতে পাঠিয়ে দেয়া হয়। কোনোরূপ আইনি ঝামেলায় যেন কাউকে জড়ানো না হয়। সবাই বাঁচুক। শুধু শুধু পৃথিবীর অক্সিজেন আর নষ্ট করতে চাই না।’

তার রুমমেট বন্ধুসহ পরিচিতজনদের বয়ানেও তার ভেতর যে বেশ কিছুদিন বেশ হতাশা কাজ করছিল সেটা উঠে এসেছে। তার বন্ধু আবদুল্লাহ বলেন, ‘কবি জসীমউদ্দীন হল মাঠে মঙ্গলবার আনুমানিক রাত ১১টা থেকে সাড়ে ১১টার দিকে তার সাথে আমার দেখা হয়েছে। অনেক দিন পর দেখা হওয়ায় তার সাথে কুশল বিনিময় করলাম। পরে সে আমার মোবাইল নিয়ে কাকে যেন ফোন দিয়েছিল। তখন তাকে ডিপ্রেসড মনে হয়েছে। এর কিছুক্ষণ পর সে আমার মোবাইল ফেরত দিয়ে দেয়। এরপর আমি চলে আসি।

ফিরোজের বেডমেট মাসুম বিল্লাহ বলেন, ‘আমি লাইব্রেরি থেকে যখন রুমে আসি। এর কিছুক্ষণ পর ফিরোজ রুমে আসে। সাড়ে ১০টার দিকে সে সবাইকে বলছে, ‘তোরা কেউ আমার কাছ থেকে কোন টাকা পাস কি না বল। এমনকি দুই টাকা হলেও বল। আমি দিয়ে দিতে চাই। পেলে এখনই বল। এর কিছুক্ষণ পর সে মানিব্যাগ এবং মোবাইল রেখে রুম থেকে বের হয়ে যাচ্ছিল।’  এসব বর্ণনা ইঙ্গিত দেয়, ফিরোজ হয়তো আত্মহত্যা করেছেন। যদিও তার হতাশার কারণ এখন পর্যন্ত স্পষ্ট নয়। আমি ব্যক্তিগতভাবে ক্যাম্পাসের একজন সাংবাদিকের সাথে কথা বলেছি। তিনি ‘প্রেমঘটিত’ বলে ইঙ্গিত দিয়েছেন। তবে ঘটনা স্পষ্ট হওয়ার আগ পর্যন্ত এখানেই থাকুক। এর আগে গত ২১ আগস্ট ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের (ঢাবি) সলিমুল্লাহ মুসলিম হলের ১৬৫ নম্বর কক্ষে ঝুলন্ত অবস্থায় একজন শিক্ষার্থীর মরদেহ পাওয়া যায়। ওই শিক্ষার্থীর নাম মঞ্জুরুল ইসলামের বাড়ি গোপালগঞ্জে। তিনি বাংলা বিভাগের (২০১৬-১৭ শিক্ষাবর্ষ) শিক্ষার্থী ছিলেন। 

দেশের বিশ্ববিদ্যালয়সহ উচ্চশিক্ষা প্রতিষ্ঠানে ২০২১ সালে ১০১ জন শিক্ষার্থী আত্মহত্যা করেছেন। প্রায় প্রতি বছর বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষার্থীদের আত্মহত্যার খবর আমরা গণমাধ্যমে দেখতে পাই। আত্মহত্যার পেছনে যেসব কারণ থাকে তারমধ্যে অন্যতম হলো- চাকরি না পাওয়ার হতাশা, পারিবারিক অশান্তি, প্রেমঘটিত সমস্যা। কিন্তু আমি মনে করি যেসব সমস্যার কারণে শিক্ষার্থীরা আত্মহত্যা করেন সেগুলোর সমাধান আছে। দুনিয়াতে মানুষ কখনো চরম অসহায় হয় না। আর্থিক সমস্যার সমাধান আছে।

বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা যথেষ্ঠ উদার। আর্থিক সমস্যার কথা বললে কোথাও না কোথাও সহায়তা মেলে। অনেকে  হয়তো বলবেন একবার, দুইবার কেউ অল্প সহায়তা করেন স্থায়ী সহায়তা করেন না, স্থায়ী সমাধান মেলে না। এ বিষয়ে আমি বলব, সহায়তা নিয়ে হলেও প্রথমে টিকে থাকতে হবে, স্থায়ী সমাধান আমাদের নিজেরদেরকেই করতে হবে। সৃষ্টিকর্তা আমাদের  হাত-পাসহ সুন্দর শরীর দিয়েছেন, মেধা-বুদ্ধি দিয়েছেন। এসব কাজে লাগাতে হবে। নিজের ভাগ্য উন্নয়নে নিজেকে পরিশ্রম করতে হবে। পরিশ্রমী মানুষ কখনো চরম আর্থিক অনটনে থাকে বলে আমি  মনে করি না। কাজকে কখনো ছোট মনে করা যাবে না।  স্বনামধন্য একজন সাহিত্যিকের ভাষায়- হাতের কাজে কোনো অগৌরব নেই, অগৌরব হয় মিথ্যা, মূর্খতা আর নীচতায়। ধৈর্য্য ধরলে পারিবারিক অশান্তিরও সমাধান মেলে। সময় নদীর মতো প্রবাহমান। পরিস্থিতি সব সময়  একরকম থাকে না। ধৈর্য্য ধরে থাকতে হবে এক সময় সমস্যার সমাধান মিলবে।

তরুণদের মধ্যে প্রেমঘটিত কারণে আত্মহত্যার পরিমাণ একটু বেশি। কারও কাছে ‘পাত্তা’ না পেলে, প্রেমের প্রস্তাবে ‘রাজি না’ হলে কিংবা কিছু সময় প্রেমের সম্পর্কে থাকার পর ‘বিচ্ছেদ’ হলে অনেকে আত্মহত্যাপ্রবণ হয়ে পড়েন। একজন মানুষ সবার কাছে সমান পাত্তা পায় না এমনকি বিশাল সম্পদ, ক্ষমতা, নজরকাড়া ফিগার/চেহেরা থাকলেও। কারও কাছে ‘বিশ্বসুন্দরী, বিশাল ক্রাশ’ কিন্তু অন্যের কাছে দেখা যায় দু’ পয়সা দাম মেলে না। সুতরাং ‘পাত্তা’ পাওয়া না পাওয়া বিষয়টি আপেক্ষিক। আর প্রেমের প্রস্তাবে একজন রাজি নাও হতে পারে। বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হওয়ার শুরুতেই অনেকে একই বিভাগের সহপাঠী কিংবা অন্য বিভাগের একই বর্ষের ছাত্র/ছাত্রীর প্রেমে পড়েন। কিন্তু দেখা যায়, অনেকে কলেজে থাকতেই প্রেম শুরু করেছেন। সুতরাং কলেজে থাকতে যে প্রেম শুরু করেছে তাকে ক্যাম্পাসে প্রস্তাব দিলে ইতিবাচক জবাব পাওয়ার প্রত্যাশা কাম্য নয়। কিংবা অন্য কোনো কারণে কেউ প্রস্তাবে রাজি না-ও হতে পারে। সেক্ষেত্রে হতাশ হওয়ার কিছু দেখি না। অন্য জায়গায় চেষ্টা করা যেতে পারে কিংবা অপেক্ষা করা যেতে পারে। প্রেমের ইতিহাসে যারা অমর তাদের অনেক ধৈর্য্য ধরার কাহিনী আমরা জানি। চন্ডীদাস রজকীনির জন্য ১২ বছর অপেক্ষা করেছেন। আবার সম্পর্কে থাকার পর বিচ্ছেদ হলেও হতাশ হয়ে আত্মহত্যা যৌক্তিক নয়। হাজার হাজার উদাহরণ আছে বিচ্ছেদের পর অন্য জায়গায় সুখী আছেন। সার্বিকভাবে আমরা বলতে পারি-প্রেমঘটিত কারণে আত্মহত্যা চরম বোকামি। 

শুধু প্রেমঘটিত নয়, কোনো কারণে আত্মহত্যা গ্রহণযোগ্য হতে পারে না। সকল প্রতিকূল অবস্থায় আমাদের ধৈর্য্যের পরিচয় দিতে হবে, সবর করতে হবে। সৃষ্টিকর্তার ইচ্ছায়/রহমতে সময়ের সঙ্গে সঙ্গে পরিস্থিতি বদলে যাবে। জীবনে অনেক আনন্দঘন মুহূর্ত আসবে তখন উপলব্ধি হবে- আহারে আত্মহত্যা করলে কী বোকামিই না হতো। আমার পরিচিত ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের একজন ছাত্রী যিনি বিচ্ছেদের পর আত্মহত্যাপ্রবণ হয়ে পড়েছিলেন। ব্লেড দিয়ে নিজের হাত কেটে ফেসবুকে পোস্ট দিয়েছিলেন। আমার সঙ্গে কথা হলে বলতেন ‘দিন-দুনিয়া আর ভালো লাগে না।’ তিনি এখন স্বামীর সঙ্গে দিব্যি সুখে-শান্তিতে বসবাস করছেন। চাকরি-বাকরি না পেয়ে চরম হতাশ পরবর্তীতে বড় চাকরি পাওয়ার খবরও আমাদের কাছে আছে। সুতরাং, ধৈর্য্য ধরে ক্রান্তিকালটা পার করতে হবে। আর আমাদের দল, মত- আদর্শের ভিন্নতা ভুলে একে অপরের প্রতি সহানুভূতি-সহযোগিতা, সহমর্মিতার হাত বাড়াতে হবে। কাউকে পেছনে ফেলে নয়, জীবনের লক্ষ্যে সবাইকে নিয়ে অগ্রসর হতে হবে। তবেই ধরণী হয়ে উঠবে মায়া-মমতাপূর্ণ, আরও সুন্দর, আরও উপভোগ্য।

লেখক: মিজানুর রহমান, সাবেক শিক্ষার্থী গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়।

সংশ্লিষ্ট সংবাদ

মন্তব্য