ফৌজদারি মামলার তদন্তে পুলিশের একটি বিশেষায়িত দল গঠনসহ বেশ কয়েকটি সুপারিশ করেছে পুলিশ সংস্কার কমিশন। নিয়োগ, বদলি ও পদোন্নতি সুষ্ঠুভাবে করা, চাকরিতে রাজনৈতিক মতাদর্শ বিচার না করাসহ বেশ কয়েকটি সুপারিশ রয়েছে এতে।
বুধবার প্রধান উপদেষ্টাকে দেওয়া প্রতিবেদনে এসব সুপারিশ করেছে পুলিশ সংস্কার কমিশন। কমিশনের প্রধান সফর রাজ হোসেন ও অন্য সদস্যরা রাজধানীর তেজগাঁওয়ে প্রধান উপদেষ্টার কার্যালয়ে প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূসের কাছে প্রতিবেদন জমা দেন।
সুপারিশে বলা হয়, পুলিশের বিশেষায়িত দলটিকে তদন্তসংক্রান্ত ইউনিট ও থানা ছাড়া অন্যত্র বদলি করা যাবে না। এ ছাড়া জেলার পুলিশ সুপার (এসপি) ও থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) হিসেবে পদায়নের জন্য ফিটলিস্ট বা বাছাই তালিকা প্রণয়ন করতে হবে। পাশাপাশি আটক ব্যক্তিদের জিজ্ঞাসাবাদের জন্য প্রতিটি থানায় স্বচ্ছ কাচে ঘেরা একটি আলাদা ‘জিজ্ঞাসাবাদ কক্ষ’ থাকতে হবে।
এতে আরও বলা হয়, থানায় সাধারণ ডায়েরি (জিডি) গ্রহণ বাধ্যতামূলক, কোনোভাবেই জিডি প্রত্যাখ্যান করা যাবে না। মামলার এজাহার গ্রহণে কোনোরূপ অনীহা বা বিলম্ব করা যাবে না। নিরপেক্ষ প্রভাবমুক্ত ‘পুলিশ কমিশন’ গঠন হবে। প্রস্তাবিত পুলিশ কমিশন আইনের আওতায় অন্তর্ভুক্ত একটি সংবিধিবদ্ধ সংস্থা হবে, নাকি সাংবিধানিক কাঠামোভুক্ত একটি প্রতিষ্ঠান হবে, তা সংশ্লিষ্ট বিষয়ে বিশেষজ্ঞ মতামতের ভিত্তিতে হওয়া বাঞ্ছনীয়।
এতে বলা হয়, অভিযানের সময় আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর প্রত্যেক সদস্যের কাছে জিপিএস ট্র্যাকিং সিস্টেম, ভিডিও রেকর্ডিং ডিভাইসসহ ভেস্ট বা পোশাক পরিধান করতে হবে। রাতের বেলায় (সূর্যাস্ত থেকে সূর্যোদয়ের মধ্যবর্তী সময়) গৃহ তল্লাশি করার ক্ষেত্রে অবশ্যই একজন নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট বা স্থানীয় সরকারের প্রতিনিধি বা স্থানীয় গণ্যমান্য ব্যক্তির উপস্থিতি নিশ্চিত করতে হবে।
তবে আইন প্রয়োগকারী সংস্থার সদস্য কর্তৃক মানবাধিকার লঙ্ঘনের অভিযোগ তদন্ত করার জন্য সরাসরি সব পদক্ষেপ নেওয়ার ক্ষমতা জাতীয় মানবাধিকার কমিশনের ওপর ন্যস্ত করতে হবে। বৈধ ও অবৈধ আদেশ প্রতিপালনের বিষয়ে প্রশিক্ষণে সম্যক ধারণা দিতে হবে। আইন প্রয়োগকারী সংস্থার প্রধান কার্যালয়েও একটি মানবাধিকার সেল থাকবে। মানবাধিকার লঙ্ঘিত হলে তাৎক্ষণিক প্রতিকার পাওয়ার জন্য নতুন হেল্প লাইন চালু কিংবা জাতীয় জরুরি সেবা (৯৯৯) নম্বরে এ ধরনের অপরাধ অন্তর্ভুক্ত করা যেতে পারে।
সুপারিশে ভুক্তভোগী ও সাক্ষী সুরক্ষার জন্য একটি সুরক্ষা আইন প্রণয়ন করা উচিত বলে উল্লেখ করা হয়েছে। যা জনবান্ধব পুলিশিং নিশ্চিত করতে সহায়ক হবে। পুলিশের জবাবদিহি নিশ্চিত করতে এবং জনবান্ধব পুলিশি ব্যবস্থা গড়ে তুলতে র্যাবের অতীত কার্যক্রম ও মানবাধিকার লঙ্ঘনের অভিযোগ পর্যালোচনা করে এর পুনর্মূল্যায়ন করা যেতে পারে। জুলাই গণ–অভ্যুত্থানের সময় ছাত্র-জনতাকে হত্যা ও আহত করার জন্য দোষী পুলিশ সদস্যদের শাস্তি নিশ্চিত করতে হবে।
নিয়োগ, পদায়ন, বদলি, পদোন্নতির ক্ষেত্রে সততা ও নিষ্ঠাকে গুরুত্ব প্রদান নিশ্চিত করতে হবে বলে উল্লেখ করতে হয়। নিয়োগপ্রক্রিয়ার সঙ্গে জড়িত কর্মকর্তা–কর্মচারীর সততা ও নৈতিকতার উচ্চমান নিয়ে সন্তুষ্ট হওয়ার পর তাঁদের নিয়োগ প্রক্রিয়ায় সম্পৃক্ত করা দরকার। প্রশ্নপত্র প্রণয়ন, পরীক্ষার খাতা মূল্যায়নে উচ্চপর্যায়ের একটি পরীক্ষা পরিচালনা কমিটির মাধ্যমে সম্পন্ন করা যেতে পারে। যেকোনো ধরনের অনিয়ম বা ব্যত্যয় হলে তাৎক্ষণিক শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নিতে হবে। পদায়ন, বদলি ও পদোন্নতির জন্য ভিন্ন ভিন্ন স্তরে সুস্পষ্ট নীতিমালা প্রণয়ন করে সংশ্লিষ্ট সবাইকে অবহিত করতে হবে।
পুলিশে কনস্টেবল থেকে এএসআই এবং এএসআই থেকে এসআই পদোন্নতিতে প্রতিবছর পরীক্ষা দেওয়া ও পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হওয়ার রীতি বাতিল করে একবার উত্তীর্ণ হলে তাঁকে শারীরিক যোগ্যতা সাপেক্ষে পরবর্তী তিন বছরের জন্য পদোন্নতির যোগ্য হিসেবে বিবেচনা করতে হবে। নারী পুলিশের সংখ্যা বাড়াতে হবে।
একইসাথে সুপারিশে ডোপ টেস্টের বিষয়েও উল্লেখ করা হয়। এতে বলা হয়, অতিরিক্ত কাজের চাপ কমাতে কর্মঘণ্টা সুনির্দিষ্ট রাখতে হবে। আট ঘণ্টার অতিরিক্ত ডিউটির ক্ষেত্রে বিশেষ প্রণোদনা চালু করতে হবে। পুলিশ সদস্যদের নিয়মিত ডোপ টেস্ট ও মানসিক পরীক্ষার আওতায় আনতে হবে। প্রতি জেলা ও মহানগর পুলিশে লিগ্যাল অফিসার্স সেল গঠন করতে হবে। কনস্টেবল ও সমমানের পুলিশ সদস্যদের কাজের ব্যাপকতা, পরিধি ও সময়কাল বিবেচনা করে পৃথক ছুটি গ্রহণ এবং ভোগের অনুশাসন/নীতিমালা সরকার বিবেচনা করতে পারে। পুলিশ সদস্যদের মানসিক চাপ কমাতে বছরে একবার ভাতাসহ নির্দিষ্ট মেয়াদের ছুটি ভোগ বাধ্যতামূলক করা উচিত।
সুপারিশে বলা হয়, থানায় বাদী–বিবাদীদের নিয়ে কোনো ধরনের মধ্যস্থতার জন্য বৈঠক বা অন্য কোনো ব্যবস্থা নেওয়া যাবে না। পুলিশের প্রশিক্ষণে অর্জিত জ্ঞান ও ফলাফলকে পদোন্নতি ও পদায়নের ক্ষেত্রে বিবেচনায় নিতে হবে। প্রশিক্ষণের ফলাফল প্রশিক্ষণার্থীর এসিআরের প্রাপ্ত নম্বরে প্রতিফলিত হতে হবে।
সুপারিশে নদী এলাকায় ভাসমান থানা গঠনের কথা বলছে কমিশন। সব বিভাগীয় শহরে ডিজিটাল ফরেনসিক ল্যাবরেটরি স্থাপন করতে হবে। প্রতিটি বিভাগে একটি ক্রাইমসিন ইউনিট/ব্যালাস্টিক শাখা গঠন করা যেতে পারে। প্রতিটি বিভাগে জাল নোট ও অন্যান্য জাল দলিলাদি শনাক্তকরণের জন্য ইউনিট গঠন করা যেতে পারে। প্রতিটি বিভাগে একটি পদচিহ্ন শাখা, একটি হস্তলিপি শাখা ও একটি ফিঙ্গারপ্রিন্ট শাখা গঠন করা যেতে পারে। প্রতিটি বিভাগীয় শহরে অটোমেটেড ডিএনএ ল্যাব স্থাপনেরও সুপারিশ করে কমিশন।
মন্তব্য