রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের ভূতত্ত্ব খনিবিদ্যা বিভাগের অধ্যাপক ড. এস তাহের হত্যা মামলায় ফাঁসি কার্যকরী ড. মিয়া মো. মহিউদ্দিনের মৃতদেহ আজ ভোররাতে পৌঁছানোর পরে পরিবার ও স্বজনেরা তার দাফন কাজ সম্পন্ন করেছেন। শুক্রবার সকল সাড়ে ১১ টায় ফরিদপুরের ভাঙ্গা উপজেলার তুজারপুর ইউনিয়নের জান্দি গ্রামের বাড়ির মসজিদ আঙ্গিনা মাঠে প্রথমে নামাজে জানাজা করা হয়।
এরপর নিজের (ড. মিয়া মো. মহিউদ্দিনের) শেষ ইচ্ছেনুসারে বাড়ির মসজিদের পাশেই পরিবারের লোকজন তার দাফন কাজ সমপন্ন করেন।
ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান, মেম্বর ও গ্রামবাসীর পাশাপাশি স্বজনেরা জানাজায় অংশ গ্রহণ করেন। ইমামতি করেন মসজিদের মোঃ মাওলানা রহিম। কান্নাজড়িত কণ্ঠে জানান ড. মহিউদ্দিনের ছোট ভাই মো. মিয়া আরজু বলে জানান, বড় ভাইর উছিয়ত মোতাবেক মসজিদের পাশেই শেষ ঠিকানায় আমাদের ভাইর দাফন কাজ সম্পন্ন করা হয়।
আমার ভাইকে ফাঁসি দিয়ে আরা জিতেগেছে বলে মনে করছে একদিন তাদেরও বিচার হবে। আমার ভাই নির্দোষ দাবী করে তিনি ভাই হারানোর বেদনায় কান্নায় ভেঙ্গে পড়েন।
বৃহস্পতিবার রাতে রাজশাহী কেন্দ্রীয় কারাগারে অধ্যাপক ড. এস তাহের হত্যায় ড. মহিউদ্দিন ও অপর এক আসামী জাহাঙ্গীরকে ফাঁসির কাষ্ঠে ঝুলিয়ে ফাঁসী কার্যকর করেন কারা কর্তৃপক্ষ। ফাঁসির কার্যকরের দুজনের মধ্যে একজন ড. মহিউদ্দিন। তিনি ফরিদপুরের ভাঙ্গা উপজেলার জান্দি গ্রামের মৃত আব্দুল মান্নান মিয়ার ছেলে।
শুক্রবার সকালে সেখানে গিয়ে দেখা যায় একটি শোঁকবিহব্বল পরিবেশ। কারো মুখে তেমন কোন কথা নেই। তার নির্মিত বাড়ির মসজিদের পাশে একটি অজু করার ঘরের পাশে একদল গোরখদক ড. মহিউদ্দিনের কবর খুঁড়ছেন। পরিবারের লোকজন সবাই বাড়ির গাছের তলে জানাজা নামাজে উপস্থিত গ্রামবাসীর সাথে কথা বলছেন। গ্রামের সাধারণ মানুষ সহসায় আদালতের রায় নিয়ে কোন মুখ না খুল্ললেও তাদের অনেকের ভাষ্য আমাদের এলাকার একজন মেধাবী সন্তান এভাবে চলে যাওয়ায় আমরা মর্মাহত। এমন মৃত্যু আমাদের কারো কাম্য নয়। সারাজীবন আমরা যেমন জেনে এসেছি আমাদের গ্রামের সূর্য মিয়া (এলাকায় পরিচিত ছিল ডাক নাম) রাজশাহীতে ভাল আছেন। যেমন মেধাবী ছিলেন তেমনি বিশাল শিক্ষিত! এরপরেও কিভাবে কি হয়ে গেল আমাদের মনে বুঝই আসছে না।
ঘরের এককোণে কাঁদছে শত বয়সের কাছাকাছি মা সেতারা বেগম। কিছু সময় পর পর তিনি মূর্ছা যাচ্ছেন। প্রতিবেশীরা তাকে শান্তনা দিচ্ছেন। কিন্ত মায়ের মন কিছুই মাঞ্ছে না। শ্রবন প্রতিবন্ধী ও দৃস্তিহীন হওয়ায় তাকে সামাল দিতে পারছেন না স্বজনেরা। শুধু নীরব কান্না আর মাঝে মধ্যে চিৎকার করে উঠছেন আমার বাজান কোথায়-কি হয়েছে ওর? স্বজনেরা জানান মা ও ছেলের দেখা নেই ১৭ বছর। মামলার পর থেকে আর বাড়িতে ফেরা হয় নি ড. মহিউদ্দিনের। সর্বশেষ বাড়িতে এসেছিল ২০০৫ সালের শেষের দিকে। বাড়ি থেকে বিদায় নেওয়ার সময় মায়ের চরণে সালাম করে মাকে বুকে টেনে নিয়েছিলেন। বলে ছিল মা আমাদের সাথে আমার বাসায় চলো। কিন্ত মা বলেছিল বাবা তোমার বাবা এই গ্রামের মাটিতে ঘুমিয়ে আছে। আমি তোমাদের সাথে যেতে পারবো না। তুমি আবার বাড়িতে আসলে তখন দেখা যাবে। মায়ের কথা শুনে ড. মহিউদ্দিন মলিন মুখ নিয়ে বাড়ি থেকে পরিবার পরিজন ও কাছের মানুষের কাছ থেকে সেদিনের বিদায় ছিল গ্রামের বাড়ি থেকে তার শেষ বিদায়।
বৃহস্পতিবার রাতে রাজশাহী কেন্দ্রীয় কারাগারে ড. মিয়া মোঃ মহিউদ্দিনের ফাঁসি কার্যকর শেষে কারাকর্তৃপক্ষ আইনগত সকল বিষয়ে সমাধানের পর রাতেই এ্যাম্বুলেন্স করে গ্রামের বাড়িতে লাশ পাঠিয়ে দেয়। শুক্রবার ভোররাতে ভাঙ্গা উপজেলার তুজারপুর ইউনিয়নের জান্দিগ্রামের বাড়িতে লাশের গাড়ি পৌছায়। বাড়ির বড় ছেলে ছিল ড. মিয়া মো. মহিউদ্দিন। তার লাশে গ্রহনের জন্য সারারাত অপেক্ষামান ছিল বিধবা মা, ভাই, বোন ও স্বজনেরা। অবশেষে লাশবহনকারী এ্যাম্বুলেন্স বাড়ির আঙ্গিনায় পৌঁছাতে প্রিয়জনেরা কান্নায় ভেঙ্গে পড়েন। তাদের স্বজন হারানোদের চিৎকার ও কান্না শুনে এগিয়ে আসেন প্রতিবেশীরা। তারা শান্তনা দেন। এ সময় সেখানে একটি হৃদয় বিদারক দৃশ্যের অবতারণা হয়। ড. মিয়া মো. মহিউদ্দিনের ছেলে বেলাকার অনেক বন্ধু রাতেই অবস্থান করেন ওই বাড়িতে। প্রবীণ শিক্ষক সুধীর বাবু জানান, মহি উদ্দিন সূর্য আমার কাছে পঞ্চম শ্রেণি পর্যন্ত লেখাপড়া করেছে। কোন সময় এহেন আচরণ করেছে বলে আমার জানা নেই। একজন মেধাবী মুখের এভাবে প্রস্থান আমাকে ব্যথিত করেছে। কিন্ত আইনের উর্ধেত আমরা কেউ নই। সৃষ্টি কর্তার কাছে প্রাথনা করি বন্ধুর মাকে তিনি এমন শোঁক বহন করার শক্তি দিন।
উপস্থিত তুজারপুর ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান ওলিউর রহমান বলেন, আমাদের ভাঙ্গায় এমন একজন মেধাবী মানুষ আর কখনও আসবে কিনা আমি বলতে পারবো না। কিছু কিছু মৃত্যু আমাদের ব্যথিত করে। উচ্চ মেধাবী মানুষদের আমরা সম্মান করি এবং আজীবন করতে হবে। আমি মনে করি আমরা একটি নক্ষত্র হারিয়েছি। এ মৃত্যু ড. মিয়া মো. মহিউদ্দি এর নয়-তুজারপুর ইউনিয়নের জনগণের।
চাচাত চাই সিকু মিয়া বলেন, আমার কানে শুধু একটি কথাই বার বার বেজে চলেছে, কারাগার থেকে আমাদের খবর দেওয়া হয়। আমার পিতা সমতুল্য বড় ভাইর সাথে শেষ বারের মত দেখা করার। বড় ভাইর স্ত্রী (ড. মিয়া মো. মহিউদ্দি) কে নিয়ে আমরা ২৫ জুলাই ভাইর সাথে দেখা করি। ভাই শুধু নীরব ও আবেগ ঘন কন্ঠে বলেছিলেন, আমি ন্যায় বিচার থেকে বঞ্চিত হলাম। এদেশে আমাদের সন্তানকে নিয়ে তুমি থেক না। দুরের দেশে চলে যেও। যাওয়ার আগে অবশ্যই সকল সম্পদ বিক্রি করে দিও। তোমারা ভাল থেক। মাকে সালাম জানিয়ে বোলো-যেন তার হতভাগা বড় সন্তান সূর্যকে ক্ষমা করে দেয়। মায়ের সাথে বাড়িতে গিয়ে আমার আর শেষ দেখা করা হল না।
প্রসঙ্গত কারনে উল্লেখ্য ১৯৮১ সালে ড. মিয়া মো. মহিউদ্দিন ভাঙ্গা সরকারি কেএম কলেজ থেকে ইন্টারমিডিমেট পাস করেন। ছাত্র জীবনে বাংলাদেশ ছাত্রলীগের রাজনীতির সাথে অতপ্রতভাবে জড়িত ছিলেন। রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে ভূতত্ত্ব ও খনি বিদ্যা নিয়ে পড়ালেখা শুরু করেন এবং মেধাবী মুখ হওয়ায় ছাত্রজীবন শেষ করে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে একই বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক হিসেবে চাকুরি জীবন শুরু করেন তিনি।
২০০৬ সালে ড. এস তাহের হত্যা মামলায় আসামি হওয়ার পর থেকে জীবনের ১৭ বছর কারাগারে জীবন পার করেন। উক্ত মামলায় তিনিসহ অপর একজন আসামীর ফাঁসি কার্যকর করেন রাজশাহী কেন্দ্রীয় কারাগার কর্তৃপক্ষ।
মন্তব্য