মনিরুজ্জামান শেখ ওরফে মনির। মৃত্যুদন্ডপ্রাপ্ত আসামি। একই মামলায় সাজাপ্রাপ্ত আসামী সাত্তার মোল্লা। দুজনের বাড়ি একই উপজেলায়। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর হাত থেকে রক্ষা পেতে তারা দেশের বিভিন্ন স্থানে ছদ্মনামে ও ছদ্মবেশে ঘুরে বেড়াতেন। অবশেষে দীর্ঘ ১১ বছর আদালতের রায়ে সাজাপ্রাপ্ত দুই আসামীকে গ্রেপ্তার করেছে র্যাব-১০ ফরিদপুরের একটি আভিজানিক দল। গ্রেপ্তারকৃতরা ফরিদপুরের চাঞ্চল্যকর ইউপি চেয়ারম্যান মলয় বোসের নৃশংস হত্যাকাণ্ড মামলায় মৃত্যুদন্ড ও যাবজ্জীবন সাজাপ্রাপ্ত আসামি। মনিরুজ্জামান শেখ ওরফে মনির সালথা উপজেলার গোয়ালপাড়া গ্রামের সামচু শেখের ছেলে। একই উপজেলার খাগৈর গ্রামের কাশেম মোল্লার ছেলে যাবজ্জীবন সাজাপ্রাপ্ত সাত্তার মোল্লা।
বৃহস্পতিবার দিনগত রাত ১টার দিকে নারায়ণগঞ্জ জেলার রুপগঞ্জ ও সিদ্ধিরগঞ্জ এলাকা হতে তাদের গ্রেপ্তার করা হয়। ২০১২ সালের ৭ ফেব্রুয়ারি জেলার সালথা উপজেলার আটঘর ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান মলয় বোস নৃশংস হত্যার শিকার হন। দীর্ঘ ১১ বছর পর র্যাবের অভিযানে ওই দুই আসামী গ্রেপ্তার ঘটনায় শহরে বেশ চাঞ্চল্য সৃষ্টি হয়েছে।
এর আগে গতকাল শুক্রবার সকাল ১১ টায় সংবাদ সম্মেলনে র্যাব-১০ ফরিদপুর ক্যাম্পের কোম্পানি কমান্ডার কে. এম. শাইখ আকতার আসামি দুজনকে গ্রেপ্তার বিষয়টি সাংবাদিকদের নিশ্চিত করেন।
র্যাব জানায়, গোপন সংবাদের ভিত্তিতে র্যাব-১০ এর আভিযানিক একটি দল ৩১ আগস্ট বৃহস্পতিবার রাত সাড়ে ৮ টার দিকে ও রাত ১ টায় নারায়ণগঞ্জ জেলার রুপগঞ্জ ও সিদ্ধিরগঞ্জ এলাকায় পৃথক দুটি অভিযান পরিচালনা করে জেলার সালথা উপজেলার আটঘর ইউপি চেয়ারম্যান মলয় বোসকে নৃশংসভাবে হত্যা মামলায় মৃত্যুদন্ডপ্রাপ্ত পলাতক আসামি মনিরুজ্জামান শেখ ওরফে মনির ও একই মামলায় অপর যাবজ্জীবন সাজাপ্রাপ্ত পলাতক আসামি সত্তার মোল্লাকে আটক করা হয়। র্যাবের প্রাথমিক জিজ্ঞাসাবাদে আসামিরা ওই হত্যাকান্ডের সাথে তাদের সরাসরি জড়িত থাকার কথা স্বীকার করে।
জিজ্ঞাসাবাদে আরও জানা যায়, ইউপি নির্বাচনকে কেন্দ্র করে আটঘর ইউনিয়ন চেয়ারম্যান মলয় বোস এর সাথে মনির ও সত্তারসহ তাদের দলের বেশ কয়েকজনের বিবাদের সৃষ্টি হয়। ওই বিরোধ কেন্দ্র করে মনির ও সত্তারসহ তাদের দলের আরও ২০ থেকে ২৫জন মিলে মলয় বোসকে হত্যার পরিকল্পনা করে। ২০১২ সালের ফেব্রুয়ারি মাসের ৭ তারিখে মলয় বোস নিজস্ব মোটরসাইকেলযোগে ইউনিয়নে যাওয়ার উদ্দেশ্যে নিজের বাসা থেকে বের হয়।
হত্যাকারীদের পূর্ব পরিকল্পিত নক্সা অনুসারে আনুমানিক সকাল ১১ টার দিকে জেলার কোতয়ালী থানাধীন রনকাইল গ্রামের নিটকস্থ একটি পাকা রাস্তার উপর পৌছায় চেয়ারম্যান মলয় বোস। এসময় মনির ও সত্তারসহ তাদের দলের লোকজন (কিলিং মিশনের সদস্যরা) দেশীয় অস্ত্রশস্ত্র (রাম দা, ছ্যান দা, চাপাতি, লোহার রড, লাঠি ইত্যাদি) নিয়ে হত্যার উদ্দেশ্যে মলয় বোস এর উপর আক্রমন করে।
এসময় মলয় বোসের মাথায় ও শরীরের বিভিন্ন স্থানে দা, চাপাতি ইত্যাদি দিয়ে এলোপাতারি কুপিয়ে নৃশংসভাবে হত্যা করে ঘটনাস্থল থেকে পালিয়ে যায় কিলিং মিশনের সদস্য খুনীরা। ঘটনাটি প্রকাশ্য দিবালোকে হওয়ায় স্থানীয় লোকজন ঘটনাটি জানতে পেরে তারা পুলিশকে সংবাদ দিলে কোতয়ালী থানা পুলিশ মলয় বোসের লাশ উদ্ধার করে ময়না তদন্তের জন্য স্থানীয় হাসপাতলের মর্গে প্রেরণ করে।
র্যাব জানায়, একজন নির্বাচিত চেয়ারম্যানকে দিনের বেলায় প্রকাশ্য কুপিয়ে নৃশংস এই হত্যাকাণ্ড দেশব্যাপী পত্রপত্রিকা,টিভি মিডিয়াসহ সর্বত্র ব্যাপক আলোচিত হয় চাঞ্চল্যকর অবস্থা সৃষ্টি করে। হত্যাকান্ডের পর নিহত ইউপি চেয়ারম্যান মলয় বোসের স্ত্রী ববিতা বোস বাদি হয়ে ফরিদপুর কোতয়ালী থানায় একটি হত্যা মামলা দায়ের করেন।
যার মামলা নং-০৯, তারিখ-০৯/০২/২০১২ খ্রিঃ, ধারা-১৪৩/ ৩৪১/ ৩২৩/৩ ২৬/ ৩০৭/৩০২/১১৪/৩৪ দন্ড বিধি।
মামলার শুনানী পরবর্তীত ঢাকার ৪ নম্বর দ্রুত বিচার ট্রাইব্যুনাল মামলার ৯ জন আসামীকে মৃত্যুদণ্ড ও ১২ জনকে যাবজ্জীবন কারাদন্ডের আদেশ প্রদান করেন।
র্যাব-১০, সিপিসি-৩ এর কোম্পানী অধিনায়ক কমান্ডার কে. এম শাইখ আকতার আরও জানান, গ্রেপ্তারকৃত মনির ও সাত্তার উক্ত হত্যাকান্ডের পর থেকে নারায়ণগঞ্জসহ দেশের বিভিন্ন এলাকায় বিভিন্ন ছদ্মবেশ ধারণ করে আত্মগোপন করে ছিল। আসামীদের আইনের আওতায় আনতে র্যাব ১০ (ফরিদপুর ক্যাম্প) কাজ শুরু করে ও দীর্ঘ প্রায় এক যুগ পর আসামী মনিরুজ্জামান ও সাত্তার মোল্লাকে নারায়ণগঞ্জ এর রুপগঞ্জ ও সিদ্ধিরগঞ্জ থেকে গ্রেপ্তার করতে সক্ষম হয়।
উল্লেখ্য ২০১২ সালের ৭ ফেব্রুয়ারি মোটরসাইকেলে বাড়ি ফেরার পথে প্রতিপক্ষের হাতে খুন হন আটঘর ইউনিয়নের তৎকালীন জনপ্রিয় চেয়ারম্যান মলয় বোস। তার স্ত্রী ববিতা বোস বাদী হয়ে ফরিদপুরের কোতয়ালী থানায় একটি হত্যা মামলা করার পর ২০১২ সালের নভেম্বরে মামলাটি ঢাকার দ্রুত বিচার ট্রাইব্যুনালে পাঠানো হয়। ২০১৩ সালের ২৪ মার্চ রোববার ঢাকার দ্রুতবিচার ট্রাইব্যুনাল-৪ এ মামলার রায় ঘোষণা করেন। বিচারিক আদালতে এই মামলার ৯ আসামিকে মৃত্যুদণ্ড ও ১২ জনকে যাবজ্জীবন কারাদণ্ড দেওয়া হয়।
হাইকোর্ট মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্তদের মধ্যে চারজনকে খালাস দিয়ে পাঁচজনকে যাবজ্জীবন দেন। ওই পাঁচজন হলেন, উজ্জল, মিজানুর, মামুন, মনিরুজ্জামান ও বেলায়েত। এছাড়া বিচারিক আদালতে যাবজ্জীবন সাজাপ্রাপ্ত ১২ জনের মধ্যে হাইকোর্ট চারজনের দণ্ড বহাল রেখে আটজনকে খালাস দেন। তারা চারজন হলেন, সাত্তার মোল্লা, আক্কাস, নজরুল ও ইমরান।
মন্তব্য